সেলিনা শেলী :
আশির দশকের গোড়া থেকে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। ছাত্র জীবনে নানা সাংগঠনিক তৎপরতা, অভিনয়, আবৃত্তি, বিতর্কসংস্কৃ কাজ ও খেলাধুলার অগ্রণী ছিলেন। বামধারার ছাত্র রাজনীতিक মাইয়ের গণআন্দোলনে, চাকসু নির্বাচনে, এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কার্যক্রমে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। আশির দশকে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালরের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যুগ্ম সম্পাদক, কালচারাল স্কোয়াড চবি-এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। মৌলবাদী জামা- শিবিররের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কবার হামলার শিকার হন তিনি। ৯০-এর ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালরের ইতিহাসে বর্বরতম হামলার পর মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁকে তিনমাস ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকুমারসভা এবং রাশান নাটক- বিপ্লবগাথা'র অভিনয় করে সারাদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। শেলী একাধারে কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। যখন কবি-স্বরের স্বরভঙ্গিতে সমসাময়িক কবিদের চেয়ে আলাদা। যখন প্রাবন্ধিক- ব্যবচ্ছেদে নির্মোহ- গুণবিচারী। ইতোপূর্বে তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ “কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা” ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। "সেদিন কী দিন ছিল এ দিন কী দিন” “কতিপয় কবিতার কথা” ও “কবে থেকে ট্রেনে ওঠে বাংলা কবিতা"য় শক্তিমান গদ্যশিল্পীর পাশাপাশি তার প্রজ্ঞা ও মননশীলতার পরিচয় পান পাঠক। কবিতায় সেলিনা শেলীর স্বর একেবারেই নিজস্ব। এই দ্বিধাসময়ের কালমঞ্চে তিনি কেবল চাক্ষিকই নন, রূপকারও বটে। পাশাপাশি প্রতিরোধ প্রতিবাদে শাণিত উজ্জ্বল তার পক্তিমালা।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (২০ তম ব্যাচ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। অত্যন্ত সাহসী, সৎ ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সেলিনা শেলীর ছাত্রজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে মুক্তচিন্তার লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকায় অত্যুজ্জ্বল।
আশির দশক থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য লিখে চলেছেন। অনেকগুলো লিটল ম্যাগাজিন ও পত্রিকার সাথেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইতোমধ্যে নানা সংগঠনের সম্মাননাও পেয়েছেন। পেয়েছেন কাব্যসাহিত্যে অবদানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একুশে পদক ও কবি ওহীদুল আলম সাহিত্য পুরস্কারও। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ২০২১ সালে প্রয়াত কবি-সাংবাদিক শাহিদ আনোয়ারের স্ত্রী। তাঁর দুই পুত্র- ইরাবান তুর্য ও নিবিড় নীলিম। পেশাগত জীবনে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজ-র প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর জন্ম ১৭ জুলাই, ১৯৬৭ সাল।
..
কবি শাহিদ আনোয়ার- বাংলা কবিতার এক অবিস্মরণীয় বেদনাপুত্র, যাকে বাদ দিলে বাংলা কাব্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! প্রকৃতির নিষ্ঠুর অবিচারে জর্জরিত যার জীবন। পিতৃপরিবারের চিরঅবহেলার শিকার, যে আমার সন্তানের পিতা, আমার চিরনমস্য প্রেমিক ও কবি।
শাহিদ আনোয়ার- যে তুখোড় মেধাবী ছাত্র, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক- চলে গেছে করোনা নিদানকালে স্ট্রোকের রক্তক্ষরণে, প্রায় দুই বছর কোনো কথা না বলে, অবশ বিবশ বিপর্যস্ত দেহমনে— সে আমার প্রিয় কবি, বন্ধু-ভালোবাসা নামে ডাকে যারে লোকে। করোনার করালকালে চিকিৎসার বন্ধ ঘরে ঘরে ফিরেছি যখন আমি অসহায়,- যখন তার কথাগুলো নিজেই বলেছি, নিজের কথাও শুনিয়েছি তাকে,- বলেছি- 'বিশ্বাস রাখো কবি, হাত ধরে আছি, একদিন সব মিথ্যে করে তুমি আমার নাম ধরে ডেকে উঠবে, দেখো!' কবি শাহিদ আনোয়ার কথা রাখেনি। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ কালরাত্রিতে সে চলে গেছে, যে কিনা জন্মেও ছিলো একই মাসের ০৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে। শাহিদের ছেঁড়া জিভের কথাগুলো হয়তো আমি বলতে পারিনি, কিন্তু আমাদের যৌথ অনুভবে রচিত পংক্তিতে আমিই তার রক্ষাকারী- আমিই তার কবরফুল। মৃত্যু কোনো বিচ্ছেদ নয়- শাহিদ জানে আমাদের প্রেম অপার-অক্ষয়।
.
সেলিনা শেলী
বইমেলা ২০২৩